হসপিটাল_রহস্য ۔প্রথম পর্ব

পার্ট_১
কোনো কারণ ছাড়া কাউকে সুইসাইড করতে শুনেছেন? সুইসাইড করে এমন মানুষের সংখ্যা কম না, কিন্তু সুইসাইড করার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকে।
আমি এখন এমন একটা হসপিটালে আসছি, যেখানে কেউ ভর্তি হলে তারা নিজের ইচ্ছায় সুইসাইড করে ফেলে।
সেটাও আবার কোনো কারণ ছাড়া।
বিনা কারণে সুইসাইড। ভাবা যায়??
.
.
আমার সামনে বসে আছেন ওসমানীনগর হসপিটালের হেড ডাক্তার সিনহা।
ওনিই কল দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
-তো ডাক্তার সিনহা, আপনি বলতে চাচ্ছেন এই হসপিটালে যেই এসে ভর্তি হোক, সে নিজের ইচ্ছায় সুইসাইড করে”?
-জ্বী মেহরাব স্যার, এটা এখন এই এলাকার সবাই জানে। কেউ নিজের রোগীকে এই হসপিটালে আর রাখতে চাচ্ছেনা। আমি ভয় পাচ্ছি হসপিটালটা না বন্ধ করে দিতে হয়”।
-বিনা কারণে কেউ আত্মহত্যা কেনো করবে? এটা আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছেনা”?
-আমি জানি আপনাদের পুলিশদের কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না, কিন্তু এটাই হচ্ছে এই হাসপাতালে। গতকাল রাতেও একটা মেয়ে সুইসাইড করেছে, অথচ তার পরেরদিন সে রিলিজ হওয়ার কথা ছিলো। সন্ধ্যায় যখন মেয়েটার সাথে আমার কথা হয়, খুব বেশি খুশি ছিলো। আমার সাথে হেসে হেসে কথা বললো। ওই রাতেই মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করে। কোনো কারণ ছিলোনা সুইসাইড করার”।
ডাক্তার সিনহার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। আমার পুলিশের ক্যারিয়ারে এরকম টাইপের কেস আগে কখনো দেখিনি। বিষ্ময় নিয়ে বললাম-
-কোনো মেয়ে সুইসাইডের আগে রেপ হয় না’তো”?
-আরে না স্যার, এই দেখুন গতকাল সুইসাইড করা মেয়েটার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। রেপ টেপ এসব কিছুই না।
আর এখানে শুধু মেয়ে না, ছেলেরাও সুইসাইড করছে”।
আমি অবাক হয়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটার সাথে কেউ জোর করেনি, শরীরে কোথাও কোনো আঁচ নেই, হাতাহাতি নেই, এমনি এমনি সুইসাইড? বিশ্বাস হচ্ছেনা।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কন্সটেবল আসিফের দিকে একবার তাকালাম, ছেলেটা রীতিমতো ভয় পাচ্ছে৷
হয়তো ভাবছে এখানে ভূত টাইপের কিছু একটা হবে। আমাকে কিছু বলার সাহস ও পাচ্ছেনা, কারণ আসিফ ভালো করেই জানে এসব আত্মা ভূতে আমি বিশ্বাসী না। ডাক্তার সিনহাকে বললাম-
-আচ্ছা খারাপ আত্মা বা অলৌকিক কিছুতে আপনি বিশ্বাস করেন”?
ওনি কিছু সময় চুপ করে রইলেন৷ হয়তো ওনার মাথায় ও কিছু কাজ করছেনা। কিভাবে করবে? ওনার হসপিটালে বিনা কারণে মানুষ সুইসাইড করছে, তার কাছে বিজ্ঞানের ভাষায় সেটার কোনো উত্তর নেই। অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ও নেই। কিছু সময় চুপ থাকার পর বললেন-
-স্যার এখানে কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে আমি জানিনা। আমি শুধুমাত্র আমার হসপিটালটা আগের মতো চাই। আমি চাই মানুষ আগের মতো আমাদের বিশ্বাস করে এখানে আসুক। হসপিটালে হাতেগুণা কয়েকজন রোগী ছাড়া এখন কেউ নেই। সবাই ভয়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। আপনি প্লিজ আমাদের হেল্প করুন”।
ডাক্তার সিনহাকে দেখলাম একদম ভেঙে পড়েছেন। এই মুহুর্তে শান্তনা দেওয়া ছাড়া আমার কিছু করার নেই। ওনাকে বললাম-
-চিন্তা করবেন না, আগামীকাল থেকে হসপিটালটা আমরা নজরে রাখবো। সব ঠিক হয়ে যাবে”।
ওইদিন সন্ধ্যায় ডাক্তার সিনহার সাথে কথা বলে বাসায় চলে আসলাম। কিন্তু মাথা থেকে সুইসাইডের কেসটা সরাতে পারছিনা। নিজের জীবনটা মানুষ বিনা কারণে শেষ করে দিবে? কিভাবে সম্ভব”?
.[সম্পূর্ণ গল্প পেতে আমার মোঃ হুমায়ুন মজুমদার আইডিটা ফলোদিয়ে রাখুন]
.
রাতে খাবার টেবিলে আমাকে আনমনা দেখে আমার স্ত্রী মিহি বললো-
-কি’গো? এতো টেনশন কিসের”?
মিহির কথার কোনো উত্তর দিলাম না। মাথায় সুইসাইডের কেসটা একদম ঢুকে গেছে। মিহি এবার আমার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বললো-
-মেহরাব ঠিক আছো তুমি”?
-হু আমি ঠিক আছি। কিন্তু মিহি বিনা কারণে কেউ কি সুইসাইড করে? ওসমানীনগর হসপিটালে মানুষ এমনি এমনি সুইসাইড করছে। কোনো কারণ ছাড়া। আমি কিছু ভাবতে পারছিনা। আত্মা বা ভূত টাইপের কিছু নয়তো”?
আমার কথা শুনে মিহি হাসলো। অনেক জোরে হাসলো। বললো-
-হায়রে বোকা, এই ২০২০ সালেও তুমি ভূতের কথা বলছো? দেখিও এসবের পিছনে কোনো মানুষ আছে নিশ্চিত। একদিন ঠিক ধরা পড়বে।
তুমি এগুলো নিয়ে চিন্তা করিও না’তো”।
মিহির কথা শুনে ভিতরে কিছুটা শক্তি অনুভব করলাম। এই মেয়েটা আমার পাশে থাকলে আমি সবসময় ভরসা পাই। শান্তি পাই। মিহি, আমার প্রচন্ড অশান্তির মধ্যে যে এক টুকরো স্বস্তি।
.
.
ভোর ৬টায় মোবাইলের রিংটা বেঁজে উঠলো। ডাক্তার সিনহার কল। ধরলাম। ওপাশ থেকে ভয়ার্ত কন্ঠে ডাক্তার সিনহা বললেন-
-স্যার আপনাকে রাতে কতোবার কল দিছি। আপনি ধরেন নি কেনো”?
ঘুমন্ত কন্ঠে বললাম-
-আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছু হইছে”?
-স্যার আরো একটা সুইসাইড।
একটা মেয়ে নিজের হাতের রগ কেটে সুইসাইড করেছে। আমার ভীষণ ভয় লাগছে স্যার। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ”।
কথাটা শুনে বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। বললাম-
-আমি আসছি৷ আপনি অপেক্ষা করুন”।

.
হসপিটালে গেলাম। দেখলাম একজন মহিলা চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলছেন “আমার মেয়েকে তুমিই মেরেছো ডাক্তার, তুমি খুনি, তুমি হত্যাকারী”।
বুঝতে পারলাম ওনি সুইসাইড করা মেয়েটার মা। ডাক্তার সিনহাকে দেখলাম ওনার ঠিক সামনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। নিঃশব্দ।
মহিলাটা অবিরাম কান্না করে যাচ্ছেন। ওনার পাশে গিয়ে বললাম-
-আপনার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কান্না থামিয়ে দয়া করে আমাকে বলুন, ঠিক কি হয়েছিলো রাতে”?
ওনি কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন-
-স্যার আমার মেয়ের নাম রিয়া। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছিলো। গতকাল সন্ধ্যায় হুট করে কেমন যেনো করতে লাগলো, বলছিলো বুকে ব্যাথা হচ্ছে খুব। আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে আসি। যদিও আমি জানতাম এই হসপিটালের বিষয়ে মানুষ নানান কথা বলছে, কিন্তু আমার মেয়ের অবস্থা খারাপ থাকায় আর এই হসপিটাল কাছে হওয়ায় এখানেই নিয়ে আসি।
আর তারপর~
ওনি থামলেন। আবারো জোরে জোরে কান্না শুরু করলেন। আমি বললাম-
-প্লিজ কান্না থামান, আমাকে বলুন তারপর কি হয়েছে”?
কান্না করতে করতে ওনি আবারো বলা শুরু করলেন-
-স্যার এখানে নিয়ে আসার পর ডাক্তার সিনহা রিয়াকে একটা ইনজেকশন দেন। কিছু সময় পর রিয়ার ব্যাথা কমতে শুরু করলো। ডাক্তার সিনহা বললেন রিয়াকে ২-৩টা দিন হসপিটালে রেখে ট্রিটমেন্ট করতে হবে”।
আমার ভিতরটা রাজি হচ্ছিলো না স্যার। তারপরেও ডাক্তার সিনহা আমাদের বহু আগের পরিচিত হওয়ায় আমি তাকে বিশ্বাস করলাম। এখানে থাকতে রাজি হলাম”।
আমি আমার মেয়ের সাথেই ছিলাম।
রাত ১টার দিকে রিয়া বেড থেকে উঠে বসলো। আমি জিজ্ঞাস করলাম
“কি হয়েছে রিয়া”?
আমার কথার কোনো উত্তর দিলোনা। চুপচাপ বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। আমি ভাবলাম হয়তো বাথরুম পেয়েছে। কিন্তু ওয়াশরুম থেকে আমার মেয়েটা আর ফিরেনি স্যার।
প্রায় ৩০মিনিট পরেও যখন দরজা খুলছিলো না, আমি জোরে জোরে রিয়াকে ডাকা শুরু করি। কোনো উত্তর নেই। আমি ভয় পেয়ে যাই। একটা ওয়ার্ড বয়কে ডেকে নিয়ে এসে দরজা ভেঙে দেখি আমার মেয়েটা ফ্লোরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। হাত থেকে অবিরাম রক্ত পড়ছিলো। একটা ছুরিও ছিলো ওর হাতে”।
ওনি আবারো জোরে জোরে কান্না শুরু করেছেন। অবিরাম চোখ থেকে পানি পড়ছে। অন্যদিকে আমার হৃদপিন্ডটা ধুক ধুক করছে। কি হচ্ছে এসব? একটা মেয়ে এভাবে বিনা কারণে ওয়াশরুমে গিয়ে সুইসাইড করবে কেনো?
তাহলে কি সত্যি সত্যি এই হসপিটালে অলৌকিক কিছু? নাহহহ, একদম না। আমি ভূত টাইপের কিছু বিশ্বাস করিনা।
.
রিয়ার আম্মুকে বললাম-
-রিয়া ওয়াশরুমে যাওয়ার ঠিক ২ঘন্টা আগে থেকে কি কি হয়েছিলো আমাকে বলুন”?
-স্যার রাত ১১টায় আমি আর আমার মেয়ে একসাথে ডিনার করি। সবকিছু স্বাভাবিক ছিলো। রিয়ার বুকের ব্যাথাটাও কম ছিলো।
১১:৩০ এর দিকে রিয়ার কাছে একটা কল আসে। বেডে শুয়ে শুয়ে রিয়া অনেক সময় কথা বলে। প্রায় ৪০ মিনিট। আমি ভাবলাম হয়তো ফ্রেন্ডরা কল দিয়ে খুঁজ খবর নিচ্ছে।
১২:১০ মিনিটে আমি একবার ওয়াশরুমে যাই ৫মিনিটের জন্য।
এসে দেখি রিয়া ওপাশ হয়ে শুয়ে আছে। আমি আর রিয়াকে কিছু জিজ্ঞাস করিনি।
তারপর রাত ১টায়~~~ ওনি আবারো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছেন। বললাম-
-তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন রিয়া ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে কোনো ডাক্তার বা নার্স কেউ রিয়ার কাছে আসেনি”?
-নাহ স্যার। কেউ আসেনি”।
ওনার চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়েই যাচ্ছে। মায়েদের মন। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর যন্ত্রণাটা আমি বুঝতে পারছি। ওনার সাথে আর কোনো কথা বাড়ালাম না। কিন্তু ওনার ৩টা কথা আমার মাথায় ঢুকলো।
“রিয়া লং টাইম ফোনে কথা বলছিলো”
“ওনি ৫মিনিটের জন্য ওয়াশরুমে যান”
“ওয়ার্ড বয়কে নিয়ে এসে দরজা ভাঙেন”।
ডাক্তার সিনহাকে জিজ্ঞাস করলাম
“কোন ওয়ার্ড বয় দরজা ভাংছে”?
ডাক্তার কিছু বলার আগেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে বললো-
“স্যার আমি রাজু। ওয়ার্ড বয়। গতকাল রাতে আমিই ডিউটিতে ছিলাম।
এই মহিলা হুট করে পাগলের মতো দৌড়ে আসলেন। বললেন ওনার মেয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলছেনা।
আমি ওনার সাথে গেলাম। নিজেও কয়েকবার ডাকলাম। উত্তর না পেয়ে দরজা ভেঙে দেখি ওনার মেয়ে ফ্লোরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে”।
এসব কথা শুনে আমার মাথা কাজ করছেনা। এটা কিভাবে সম্ভব? নিজের জীবনটা তো কেউ এমনি এমনি দিবেনা।
ওয়ার্ড বয় রাজুকে বললাম-
“চলো, তুমি যখন লাশটা প্রথম দেখেছো তাহলে তোমকে নিয়েই ওয়াশরুমটা দেখে আসি”।
ওয়াশরুমের ভিতরে গেলাম। দেখলাম এই একটা দরজা ছাড়া ভিতরে যাওয়া আসার অন্য কোনো উপায় নেই। তারমানে অন্যদিকে ভিতরে এসে মার্ডার করে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ এটা নিশ্চিত সুইসাইড।
কিন্তু এই হাসপাতালে কি এমন আছে? যেখানে আসলে মানুষ এমনি এমনি সুইসাইড করবে? কিভাবে সম্ভব?? বিনা কারণে সুইসাইড?
আমার সেটা মনে হয়না। কিছু তো একটা আছে। কারণটা আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে”।
.
রিয়ার মোবাইলটা নিয়ে থানায় চলে আসলাম। কল লিস্ট বের করে দেখলাম একটা নাম্বারে সবসময় কথা বলতো, তাও আবার লং টাইম। মৃত্যুর আগে মোবাইলে শেষ কথা বলাটা ওই নাম্বারেই। ৩৯মিনিট ১৩সেকেন্ডের কল। নাম্বারটা “ফাহাদ” নামে সেভ করা। আমি রিয়া সম্পর্কে খুঁজ নেওয়া শুরু করলাম।
মেয়েটার স্কুল থেকে শুরু করে ভার্সিটি অবধি কোনো শত্রু নেই। প্রচন্ড ভালো আর মিশুক টাইপের মেয়ে। ফ্যামিলি প্রবলেম ও নেই। তাহলে সুইসাইড কেনো করবে”? তবে কি সুইসাইডের কারণ ওই ৩৯মিনিট ১৩সেকেন্ডের কল”? আমি জানিনা। আমার মাথা কাজ করছেনা। ভূতে বা নেগেটিভ পাওয়ারে বিশ্বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা কম না। হ্যা আমি বিশ্বাস করিনা এটা ঠিক, কিন্তু এই সুইসাইড হওয়ার পিছনে কারণগুলো যদি বের করতে না পারি, বা এই হাসপাতালে মানুষ যদি আসলেই বিনা কারণে সুইসাইড করে, তাহলে আমি নিরুপায় হয়ে এসবে বিশ্বাস করতে বাধ্য। আচ্ছা এই হাসপাতালে কোনো আত্মার অভিশাপ টাইপের কিছু নয়তো?উফফফ… এগুলো কি ভাবছি আমি?
আমার মাথা একদম কাজ করছেনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত, অন্তত একটা সুইসাইডের কারণ বের করতে পারলে বাকি সুইসাইডের রহস্যগুলোও ঠিক বের হয়ে আসবে।
.
গল্পহসপিটালরহস্য 💀
পার্ট- ১
লেখক: মেহরাব নয়ন।
